Friday, March 5, 2010

Goppogaachhaa

গপ্পগাছা

হঠাৎ কোথাও দেখা হয়েছিল তাদের
মেয়েটি তখন যমুনার নীল সাঁকো
ছেলেটি যদিও শুকনো বোশেখ জুড়ে
ছায়া খুঁজেছিল...

আমি জানতাম ওদেরকে, আজও জানি
মেয়েটা এখন ভীষণ ব্যস্ত, দূরে
ছেলে ইদানীং গম্ভীর, পরিপাটি
ছেলে ইদানীং সারা মাস ভবঘুরে

ওদের গল্প কিছুটা শোনাই ছিল
বাকি কিছু ছিল গোপনীয় আন্দাজে
কেন কাছে আসা, কেনই বা সরে যাওয়া
কেউই বলেনি, হয়তো বা লোকলাজে

কিছুদিন আগে, সন্ধের অজুহাতে
ছেলেটার সাথে দেখা হল ওলিপাবে
এক কোণে বসে সুরাপানে মনোযোগী
সময় কাটাতে... এবং মধ্বাভাবে

কথা যা যা হল... খাপছাড়া খাপছাড়া
আড্ডা ভাঙল – রাত প্রায় সাড়ে ন'টা
আমি মদে চুর, ছেলেটা তথৈবচ
কাঁধে হাত রেখে চলেছে প্রগলভতা -

'মাঝে মাঝে এখনো দেখা হয় আমাদের, ভাবতে পারিস,
নয় নয় করে বছরে পাঁচ-ছ' বার। খুব ভোরে, দিল্লী এয়ারপোর্ট
পাশাপাশি বসে আছি, কফি হাতে। ও যাবে মুম্বই আর আমি
কলকাতা। একটু একটু করে সূর্য উঠছে ঠিক রানওয়ে ঘেঁষে।
ওর চোখেমুখে ছড়ানো হালকা ঘুম। কোনদিন বলল না
কোন পারফ্যুম মাখে, স্কাউণ্ড্রেল? শ্যানেল ফাইভ?'

'কী কী কথা হয়?'

'সে অনেক কথা। গেল বার ভেসে গেছি অর্থনীতির তোড়ে -
জমা পুঁজি, সঞ্চয়, ফিসকাল স্পেস। শেষে দেখি বুঝিয়ে বলবে বলে
খুঁজছে কলম। অগত্যা বললাম এবার খান্তি দে মা, বাড়ি যাই।'

'সত্যি বললি এই কথা!'

'বললাম। এমনই তো বলি। কানাগলি দেখেছিস?
সামনে রাস্তা নেই, পিছনে দুরূহ চোরাবালি। তেমনই
অন্ধকারে দেখা হয়ে যায় আমাদের। খেজুরে গপ্প করি -
ও শোনায় দেশকাল, আমি বলি মোহনবাগান।'

বদলে গিয়েছে সময়, বুঝতে পারি
ওদের কথারা অধুনায় সাবালক
লজ্জা পায়না মেয়েটিও অকারণে
ছেলেটির নেই দুঃসাহসের ঝোঁক

কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল যেন?
হরি ঘোষ স্ট্রীট? ক্ষুদিরাম বোস লেন?
বৃষ্টি সেদিন ভাসিয়েছে কলকাতা
কারও ছাতা নেই...

'বিশ্বাস করবিনা, ফুটপাথে হাঁটুজল প্রায়, তেমনি বৃষ্টি
ভাগ্যে বারান্দাটা ছিল, দাঁড়ালাম তারই নীচে, দেখি -
কিছু দূরে, ভিজে চুপ্পুড়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে একা, থমথমে মুখে।
পাশের পাড়ায় বাড়ি, চেনা মুখ, তার উপর বেথুনের মেয়ে
দায়িত্ব কর্তব্য বলে ব্যাপারটা আছে, তাই না কী? ঘন্টাখানেক
পরে বললাম - যদি আপত্তি না থাকে, পাশাপাশি হাঁটা যায়
পাড়া ইস্তক।'

'ঘন্টাখানেক তবে মৌন হয়ে ছিলি?'

'প্রেয়ার করেছি স্যার, সত্যপীর, ওলাবিবি, দক্ষিণরায়
কারুকে দিইনি বাদ। এছাড়াও সত্যি বলতে গেলে
বোবা ধরেছিল, কি যে বলি, কী বলা উচিত হাতড়াতে
হাতড়াতে সন্ধে হয়ে গেল।'

মেয়েটি বলেছে - হয়ত মিনিট দশ
তারপরে না কি অনাবিল বীররসে
ছেলেটি বলেছে, 'একা যেতে ভয় করে'
মেয়ে সাথে গেছে নেহাতই দয়ার বশে

ছেলেটিও ছিল প্রকৃতই মুখচোরা
মেয়ে হাসিখুশি, কমলালেবুর ফুল
অবাক সবাই ওদেরকে সাথে দেখে
তারপরে দিন সমস্যাসঙ্কুল...

'কী যে হয়ে গেল উচ্চ মাধ্যমিকে, তুই তো জানিস
যাকে বলে ভরাডুবি। ওদিকে ওর যা রেজাল্ট -
আকাশছোঁয়া। সায়েন্স নিয়ে যে পড়ব এমন আশা
কোত্থাও নেই, অতএব সব শেষ। কত কি ভেবেছি
ভাবতেও পারবি না, পালিয়ে বাঁচব অথবা গলায় দড়ি।
তিনদিন পরে, ঠিক দুক্কুরবেলা, সে এসে হাজির,
প্রথম পদার্পণ, পুরোনো বাড়ির দক্ষিণমুখো ঘরে'

'এ গল্প জানি। খুব বকেছিল তোকে। বলেছিল না কি
ভয় কী, আমি তো আছি।
অথচ কোথাও গোলমাল হয়ে গেল...'

'ভুল বলেনি রে, সত্যিই তো সে আছে। তুই বুঝবি না,
বোঝার কথাও নয়। ডেবিট – ক্রেডিট খাতাতেই শুধু মেলে।'

মুখচোরা ছেলে কীভাবে পালটে গেল
একথা জানত শুধু তার সেই মেয়ে
আমরা দেখেছি আতশবাজীর আলো
ঝলমলে যেন গল্পকথার চেয়ে

'কোন কোন দিন তোদেরকে দেখা যেত সন্ধের আগে
সাহিত্য পরিষদে।'

'একটাই দিন, তাও সেটা শনিবারে। সারা সপ্তাহে ঐ
একদিনই দেখা হত। গোটা হপ্তার জমানো কথার পুঁজি
শেষ করে ফেলা, যেটুকু থাকত বাকি, সেটুকু চিঠিতে
লিখে ফেলা বাড়ি ফিরে।'

'চিঠি লিখতিস! দিতিস গোলাপী খামে?'

'না রে বাবা। প্রেমপত্তর লিখি তেমন খ্যামতা নেই
কস্মিনকালে। ঘরোয়া কথাই, যেমন ক্রিকেট ম্যাচ
অথবা কমন রুম। কখনো কখনো সহপাঠিনীর কথা...
যদি রেগে যায়, যদি অভিমান করে, সে মান ভাঙাবো।
অথচ সে রাগত না। গায়ে কাঁটা দেয় এমনই
কনফিডেন্স।'

'আর তারপরে...'

'তারপরে... তুই ভাবতেও পারবি না, শনিবারগুলো
কত দেরী করে আসে। কলকাতা যেন শুধু বাধা দিতে জানে
প্রতি শনিবারে... কখনো চাক্কা জ্যাম, কোন শনিবার
আচমকা হরতাল, অকারণে তার কলেজেতে হাফ ছুটি
কখনো বৃষ্টি, ভীষণ দুর্বিপাক। মনে আছে এক এরকম
শনিবারে অঝোর বৃষ্টি রাস্তায় ডুবজল। নিশ্চই মেয়ে
কোনমতে আসবে না এমনই ভেবেছি...'

'অথচ সে এসেছিল...'

'এসেছিল আর অপেক্ষা করেছিল। ভেবে দ্যাখ তুই
পাগল আর কাকে বলে। তাই নিয়ে পরে ভয়ানক
ঝড় এল, বেঁচেছি নেহাতই মোটা চামড়ার গুণে।'

'সেই থেকে বুঝি ঝগড়াঝাঁটির শুরু?'

'ঝগড়া হয়নি আমাদের কোনদিন। কেউ বিশ্বাস করে না
সে কথা জানি'

মনে হল যেন আমি বিশ্বাস করি
ভালবেসেছিল, ওরা আজও ভালবাসে
অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করেছিল
শহরে যখন শনিবার নেমে আসে

অথচ মেয়েটি এ শহর ছেড়ে গেল
ছেলেটি রইল হাসিখুশি, বাঙ্ময়
আমরা সবাই অবাক ওদের দেখে
কেবলই ভেবেছি - সত্যি এমনও হয়!

'কী যে হয়েছিল সে কথা জানিনা ঠিক। এক শনিবার
সাতানব্বই সালে, আমাকে বলল কলকাতা ছেড়ে যাবে।
এমনিই যাবে, অকারণে চলে যাবে, কলকাতা না কি
দুই চক্ষের বিষ। কত অনুনয় করেছি শহর জানে...
কী যে জেদী মেয়ে সে কথা না বলা ভাল। সারা রাত্তির কেঁদেছি
বাড়িতে ফিরে। মনে হয়েছিল দোষ কিছু ঘটে গেছে অথবা কাউকে
অন্য বেসেছে ভাল। অথচ এখনো একা একা রয়ে গেল...
দেখা হয়ে যায় দিল্লী এয়ারপোর্টে, খুব ভোরবেলা সকাল হয়নি ঠিক
সূর্য উঠছে রানওয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পাশাপাশি বসা, চুমুক, কফির কাপ...'

আমি জানতাম ওদেরকে, আজও জানি
মেয়েটা এখন ভীষণ ব্যস্ত, দূরে
ছেলে ইদানীং গম্ভীর, পরিপাটি
ছেলে ইদানীং সারা মাস ভবঘুরে

হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে গিয়েছিল
মেয়েটি যখন যমুনার নীল সাঁকো
ছেলেটি যদিও শুকনো বোশেখ জুড়ে
ছায়া খুঁজেছিল...

No comments:

Post a Comment